রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:২৬ অপরাহ্ন

অসুস্থ ব্যক্তি-সফরকারীদের নামাজ আদায়ের নিয়ম

অসুস্থ ব্যক্তি-সফরকারীদের নামাজ আদায়ের নিয়ম

মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ:
অসুস্থ ব্যক্তি কিভাবে নামাজ আদায় করবে: রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ো, যদি না পারো তবে বসে নামাজ পড়ো, যদি তা-ও না পারো তবে ইশারা করে নামাজ আদায় করো। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১০৫০)এ হাদিস থেকে বোঝা যায়, অসুস্থ অবস্থায়ও নামাজ ছেড়ে দেওয়া জায়েজ নেই। কোনো অসুস্থ ব্যক্তি নামাজের সব রুকন আদায় করতে অক্ষম হলে যেসব রুকন আদায় করতে সক্ষম সেগুলো আদায় করবে।
-যে ব্যক্তি দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করতে অক্ষম, সে বসে বসে রুকু-সিজদা আদায় করে নামাজ পড়বে। -একইভাবে কোনো অসুস্থ ব্যক্তি দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করলে রোগ বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা হলে অথবা আরোগ্য হতে দেরি হওয়ার প্রবল আশঙ্কা হলে বসে নামাজ আদায় করার অনুমতি আছে।
-আর যদি বসে রুকু-সিজদা করতেও অপারগ হয়, তাহলে সে বসে ইশারার মাধ্যমে রুকু-সিজদা করবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১০৪৭, ১০৫০)
-যে ব্যক্তি ইশারায় রুকু-সিজদা করবে, সে রুকু থেকে সিজদাতে সামান্য বেশি ঝুঁকবে। অন্যথায় নামাজ সহিহ হবে না। (তিরমিজি, হাদিস: ৩৭৬)
-সিজদা করার জন্য কোনো বস্তু ওপরে তুলে সেটার ওপর সিজদা করার প্রয়োজন নেই। (সুনানে কুবরা, হাদিস: ৩৮১৯, ইবনে আবি শায়বা: ১/২৭৩)
-কেউ যদি অসুস্থতার কারণে বসে নামাজ পড়তে অপারগ হয়, তাহলে সে শুয়ে ইশারার মাধ্যমে নামাজ পড়বে। তার পা কিবলার দিকে করে শোয়াতে হবে। মাথাকে সামান্য ওপরে তুলে শোয়াবে, যাতে চেহারা কিবলার দিকে হয়। এরপর ইশারা করে রুকু-সিজদা করবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা: ১/২৭৩)
-যদি মাথা দিয়ে ইশারা করা হয়, তা রুকু-সিজদার স্থলাভিষিক্ত বিবেচিত হবে। যদি ইশারা চোখ বা অন্তরে হয়, তাহলে নামাজ সহিহ হবে না। (সুনানে কুবরা, হাদিস: ৩৭১৯)
যদি অসুস্থ ব্যক্তি মাথা দ্বারাও ইশারা করতে অক্ষম হয়, তাহলে দেখতে হবে এ অবস্থা কতক্ষণ থাকে। যদি পাঁচ ওয়াক্ত শেষ হওয়ার পর অবস্থার উন্নতি হয়, তবে ওই সব নামাজ মাথা দিয়ে ইশারা করে কাজা করবে। যদি এর চেয়ে বেশি সময়ও উন্নতি না হয়, তবে ওই সব নামাজ তার দায়িত্ব থেকে চলে যাবে। অর্থাৎ এগুলো আদায় করতে হবে না। (মুআত্তা মুহাম্মদ, হাদিস: ২৭৮, দারা কুতনি: ১৮৮৩)ৎ

সফরে নামাজ আদায়ের পদ্ধতি: কোনো ব্যক্তি তার অবস্থানস্থল থেকে ৪৮ মাইল তথা ৭৮ কিলোমিটার দূরে সফরের নিয়তে বের হয়ে তার এলাকা পেরিয়ে গেলেই শরিয়তের দৃষ্টিতে সে মুসাফির হয়ে যায়। (জাওয়াহিরুল ফিকহ: ১/৪৩৬, আহসানুল ফাতাওয়া: ৪/১০৫)
-সফরের নিয়তে বের হয়ে নিজ এলাকা পেরোলে সফরের বিধান শুরু হয়। শহরের ক্ষেত্রে ওই শহরের করপোরেশনের নির্ধারিত সীমানা থেকে সফরের সীমা নির্ধারিত হবে। অনুরূপ সফর থেকে ফিরে আসার ক্ষেত্রেও নিজ এলাকার সীমানায় প্রবেশের সঙ্গেই তার সফরের বিধান শেষ হয়ে যাবে। (রদ্দুল মুহতার: ২/১২৮)
-আকাশপথে সফরের ক্ষেত্রেও দূরত্বের হিসাব স্থলভাগে সফরের দূরত্বের পরিমাপে হবে, অর্থাৎ স্থলভাগের ৭৮ কিলোমিটার পরিমাণ দূরত্বের সফর হলে আকাশপথে মুসাফির হবে। (রদ্দুল মুহতার: ১/৭৩৫)
-সফরকারীর জন্য শরিয়তের বিধি-বিধানে কিছু শিথিলতা রয়েছে, যথাÑচার রাকাত বিশিষ্ট ফরজ নামাজগুলো দুই রাকাত আদায় করবে, সফরে রোজা না রেখে পরবর্তী সময়ে কাজা করলেও চলবে। অনুরূপ মোজায় মাসাহ করা ইত্যাদি বিধানে সাধারণ অবস্থা থেকে ভিন্নতা রয়েছে।
-মুসাফির ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত সফর অবস্থায় চার রাকাত নামাজ পূর্ণ করলে গুনাহ হবে। এ ক্ষেত্রে নামাজ পুনরায় পড়া ওয়াজিব। আর যদি ভুলক্রমে চার রাকাত পূর্ণ করে নেয়, তাহলে যদি সে প্রথম বৈঠক করে থাকে, তাহলে সিজদা সাহু করে নিলে ফরজ নামাজ আদায় হয়ে যাবে, আর যদি প্রথম বৈঠক না করে থাকে, তাহলে ফরজ আদায় হবে না, আবারও পড়তে হবে। (বাদায়েউস সানায়ে: ১/৯১)
-মুসাফির ব্যক্তি মুকিম ইমামের পেছনে ইকতিদা করলে সে ইমামের অনুসরণে পূর্ণ নামাজই আদায় করবে। (আল মাবসুত, সারাখসি: ১/২৪৩)
-মুকিম ব্যক্তি মুসাফির ইমামের পেছনে ইকতিদা করলে চার রাকাতবিশিষ্ট নামাজগুলোতে মুসাফির ইমাম দুই রাকাত পড়ে সালাম ফেরানোর পর মুকিম মুক্তাদি দাঁড়িয়ে সুরা পড়া ছাড়া বাকি দুই রাকাত নামাজ পড়ে নেবে।
-সফর অবস্থায় ছুটে যাওয়া নামাজ মুকিম অবস্থায় কাজা করলে ‘কসর’ই আদায় করবে, আর মুকিম অবস্থার ছুটে যাওয়া নামাজ সফরে কাজা করলে তা পূর্ণ আদায় করবে। (হেদায়া: ১/৮১)
স্থায়ী আবাসস্থল পরিবর্তন করে অন্য স্থানে মূল আবাস গড়লে স্থায়ী বসবাসের জন্য সেখানে না যাওয়ার ইচ্ছা থাকলে আগের অবস্থানস্থল মৌলিক আবাসন হিসেবে গণ্য হবে না, এমনকি সেখানে তার মালিকানা জায়গা-জমি থাকলেও নয়, বরং সেখানেও সফরের সীমানা অতিক্রম করে গেলে মুসাফিরই থাকবে। (আল মাবসুত, সারাখসি: ১/২৫২)
-কোনো জায়গায় ১৫ দিন বা ততধিক অবস্থানের নিয়ত করলে সে সেখানে মুকিম হয়ে যাবে। সেখান থেকে সামানাপত্রসহ প্রস্থানের আগ পর্যন্ত সেখানে পূর্ণ নামাজ পড়বে এবং মুকিমের বিধান জারি থাকবে। (বাদায়েউস সানায়ে: ১/১০৪)
-নারীরা বিয়ের আগ পর্যন্ত তার বাবার বাড়িতে স্থায়ী আবাস হিসেবে মুকিম থাকবে। তবে বিয়ের পর যদি স্বামীর বাড়িতে মৌলিকভাবে থাকে এবং বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসে, তাহলে স্বামীর বাড়ি তার মৌলিক আবাস হিসেবে ধর্তব্য হবে এবং বাবার বাড়িতে মুসাফির থাকবে, আর যদি বাবার বাড়িতে মৌলিকভাবে থাকে, তাহলে তা তার মূল অবস্থানস্থল হিসেবেই বাকি থাকবে। (আল বাহরুর রায়েক: ২/১২৮, রদ্দুল মুহতার: ২/১৩১)। আর পুরুষরা তার শ্বশুরবাড়িতে ১৫ দিনের কম থাকার নিয়ত করলে মুসাফিরই থাকবে। হ্যাঁ, কেউ যদি সেখানে স্থায়ী আবাস করে নেয়, তাহলে তা ভিন্ন কথা।
-মুসাফির ব্যক্তির জন্য তার চলন্ত অবস্থায় বা তাড়াহুড়া থাকলে ফজরের সুন্নত ছাড়া অন্যান্য সুন্নতে মুয়াক্কাদা না পড়ার সুযোগ রয়েছে। তবে স্বাভাবিক ও স্থির অবস্থায় সুন্নতে মুয়াক্কাদা পড়তে হবে। (ইলাউস সুনান: ৭/১৯১, রদ্দুল মুহতার: ১/৭৪২)
সিজদায়ে সাহু বা ভুলের সিজদা কখন দিতে হয়: যে ব্যক্তি নামাজের কোনো ওয়াজিব কাজ ইচ্ছা করে ছেড়ে দেয়, সে গুনাহগার হবে। তার নামাজ নষ্ট হয়ে যাবে। পুনরায় আদায় করতে হবে। এর শূন্যতাও সিজদায়ে সাহু দ্বারা পূর্ণ হবে না।
-যে ব্যক্তি নামাজের কোনো ওয়াজিব কাজ ভুলক্রমে ছেড়ে দেয়, তার জন্য সিজদায়ে সাহু ওয়াজিব। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩৮৬, আবু দাউদ, হাদিস: ৮৭৪, আল মুজামুল আওসাত: ৭৮০৮)
যদি ফরজের প্রথম দুই রাকাত বা যেকোনো এক রাকাতে সুরায়ে ফাতিহা পড়তে ভুলে যায়, সেরূপ নফল ও বিতরের যেকোনো রাকাতে ভুলক্রমে সুরায়ে ফাতিহা পড়া না হয়, তখন সিজদায়ে সাহু ওয়াজিব হবে। (মুসলিম ৮৯৩)
-যদি ফরজের প্রথম দুই রাকাতে কিরাত পড়া ভুলে যায় এবং শেষ দুই রাকাতে তা পড়ে। (মুসলিম: ৮৯৫, মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা: ১/৪০৯)
-ফরজের দুই রাকাত বা এক রাকাতে কিরাত মেলাতে ভুলে গেলে সাহু সিজদা দিতে হবে। (নাসায়ি: ১২৪৩)
-যদি এক সিজদা করে পরের রাকাতের জন্য দাঁড়িয়ে যায় তখন ওই রাকাত দুই সিজদা দিয়ে সম্পন্ন করে ছুটে যাওয়া সিজদাও এর সঙ্গে মিলিয়ে নেবে। শেষে সিজদায়ে সাহু করবে, তাতে নামাজ হয়ে যাবে। (প্রাগুক্ত) আর যদি তিন বা চার রাকাতবিশিষ্ট নামাজে প্রথম বৈঠক ভুলে যায়, তা ফরজ নামাজ হোক বা নফল নামাজ, সিজদায়ে সাহু দিতে হবে। (আবু দাউদ: ৮৮২)
-যদি তাশাহহুদ পড়তে ভুলে যায়, তাহলে সাহু সিজদা দিতে হবে। (নাসায়ি: ১২৪৩)
যদি বিতর নামাজে তৃতীয় রাকাতে রুকুর আগে কুনুত পড়তে ভুলে যায়, তখন সাহু সিজদা দিতে হবে। (সুনানে কুবরা লিল বায়হাকি: ৪০৪২,)
-যদি প্রথম বৈঠকে তাশাহহুদের সঙ্গে দরুদ ইত্যাদি পড়ে ফেলে, তাহলে সাহু সিজদা দিতে হবে। (মুসলিম: ৮৯৫)
-যার ওপর সাহু সিজদা ওয়াজিব হয়েছে, সে শেষ বৈঠকে তাশাহহুদ পড়া শেষ করে ডান দিকে এক সালাম ফেরাবে। এরপর তাকবির বলে নামাজের মতো দুটি সিজদা করে বসে যাবে এবং তাশাহহুদ, দরুদ, দোয়ায়ে মাসুরা পড়ে সালাম ফেরাবে। সালামের আগে সিজদা করলে নামাজ হয়ে যাবে। তবে তা মাকরুহে তানজিহি। (মুসনাদে আহমদ: ১৮১৮৮, সহিহ বুখারি, হাদিস: ১১৫০, ১১৫৩, তিরমিজি: ৩৬১)
নামাজের রাকাত সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ হলে করণীয়: নামাজ পড়ার সময়ে রাকাত সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ হলে এবং এই সন্দেহ প্রথমবারের মতো হলে ওই নামাজ বাতিল হয়ে যাবে। নামাজ পুনরায় পড়া আবশ্যক। (ইবনে আবি শায়বা: ২/২৮)
-নামাজের সালাম ফেরানোর পর যদি রাকাত সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ হয়, তবে তার নামাজ বাতিল হয়ে যাবে। (ইবনে আবি শায়বা: ২/২৮)
-কারো যদি নামাজের পর দৃঢ়বিশ্বাস হয় যে কিছু রাকাত পড়া হয়নি, সে যদি নামাজ পরিপন্থী কোনো কাজ না করে, তাহলে ছুটে যাওয়া রাকাত পড়ে নেবে। যদি নামাজ পরিপন্থী কোনো কাজ করে ফেলে, তাহলে ওই নামাজ পুনরায় পড়বে। (ইবনে আবি শায়বা: ২/২৪)
-যে ব্যক্তির প্রায় সময় সন্দেহ হয় এবং সন্দেহ তার অভ্যাসে পরিণত হয়, তবে যেদিকে তার মন বেশি যায়, সেটার ওপর আমল করবে। যদি সব বিষয়ে ধারণা সমান হয়, তবে কমটির ওপর আমল করবে এবং প্রতি রাকাতকে নামাজের শেষ মনে করে বসবে এবং শেষে সিজদায়ে সাহু করবে। (মুসলিম: ৮৮৮)
-তিন রাকাত পড়া হয়েছে, নাকি চার রাকাত সে ব্যাপারে সন্দেহ হলে তিন রাকাত মনে করে বসবে। এরপর চতুর্থ রাকাত পড়বে। শেষে সিজদায়ে সাহু করবে। (মুসনাদে আহমদ: ১৬৭৭)
কখন চেয়ারে বসে নামাজ পড়া যাবে: ইসলাম মানুষের সহজাত ও স্বভাবজাত ধর্ম। মানুষের সাধ্যাতীত কোনো বিধান ইসলামে দেওয়া হয়নি। নামাজ আল্লাহর অলঙ্ঘনীয় বিধান। অসুস্থ হলেও নামাজ আদায় করতে হয়। কিন্তু সে ক্ষেত্রে ইসলাম কিছুটা অবকাশ দিয়েছে। বিকল্প পন্থা ও পদ্ধতিতে নামাজ আদায়ের সুযোগ দিয়েছে। তবে এর জন্য রয়েছে বিশেষ নীতিমালা। দাঁড়াতে ও সিজদা করতে সক্ষম এমন ব্যক্তির জন্য নামাজে কিয়াম বা দাঁড়ানো ফরজ। যদি দাঁড়ানো বা সিজদাদানে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও কেউ ফরজ-ওয়াজিব নামাজ বসে আদায় করে, তবে নামাজের ফরজ ছেড়ে দেওয়ার কারণে তার নামাজ হবে না। নামাজ পুনরায় পড়তে হবে। (দুররে মুখতার, জাকারিয়া বুক ডিপো: ২/১৩২)
-এমনকি সিজদা করতে সক্ষম ব্যক্তি যদি নামাজের কিছু অংশে দাঁড়াতে সক্ষম হয় এবং পুরো সময় দাঁড়িয়ে থাকতে অপারগ থাকে, তবে যেটুকু সময় দাঁড়াতে পারবে, তা কোনো লাঠি বা দেয়ালের সঙ্গে ঠেস দিয়ে হলেও সেটুকু দাঁড়ানো ফরজ। এ অবস্থায় যদি না দাঁড়ায় এবং কোনো কিছুর ওপর হেলান দিয়ে দাঁড়ানোর পরিবর্তে বসেই নামাজ আদায় করে, তবে নামাজ হবে না। (দুররে মুখতার: ২/২৬৭)
-কেউ যদি দাঁড়াতে সক্ষম, কিন্তু রুকু-সিজদা বা শুধু সিজদা করতে সক্ষম না হয়, তার জন্য বসে নামাজ আদায় করা জায়েজ। সে ইশারার মাধ্যমে রুকু-সিজদা করবে। এ ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে ইশারার মাধ্যমে নামাজ আদায় করার চেয়ে বসে ইশারায় নামাজ আদায় করা উত্তম। (দুররে মুখতার: ২/৫৬৭, ফাতাওয়ায়ে আলমগিরি: ১/১৩৬)
যেসব অক্ষমতার কারণে দাঁড়ানোর আবশ্যকতা রহিত হয়ে যায়, তা দুই প্রকার: ১. হাকিকি বা মৌলিক অর্থাৎ এমন অক্ষম, যে দাঁড়াতে পারে না। ২. হুকমি বা বিধানগত অর্থাৎ সে এমন অক্ষম নয় যে দাঁড়াতে পারে না, বরং দাঁড়ালে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা অথবা এমন দুর্বলতা থাকে, যা শরিয়তের দৃষ্টিতে অক্ষমতা বলে বিবেচিত। যেমনÑ অসুস্থতা, যার ব্যাপারে অভিজ্ঞ মুসলিম ডাক্তাররা পরামর্শ দেন যে দাঁড়ালে রোগ বৃদ্ধি পাবে অথবা সুস্থতা ফিরে আসতে বিলম্ব হবে কিংবা দাঁড়ানোর কারণে অসহনীয় ব্যথা অনুভূত হয়Ñ এসব অবস্থায় বসে নামাজ আদায় করা জায়েজ। (দুররে মুখতার মাআ রদ্দুল মুহতার: ২/৫৬৫)
যদি অসহনীয় ও অস্বাভাবিক ব্যথা না হয়, বরং সামান্য ব্যথা অনুভব হয়, তবে তা শরিয়তের দৃষ্টিতে অক্ষমতা বলে বিবেচিত হবে না। এ অবস্থায় বসে নামাজ আদায় করা জায়েজ নেই। (তাতারখানিয়া: ২/৬৬৭)
-যে ব্যক্তি দাঁড়াতে অক্ষম, কিন্তু মাটিতে বসে সিজদার সঙ্গে নামাজ আদায় করতে সক্ষম, তবে তাকে মাটিতে বসে সিজদা সহকারে নামাজ আদায় করতে হবে। মাটিতে সিজদা না করে চেয়ারের ওপর বসে বা মাটিতে বসে ইশারা করে নামাজ আদায় করা জায়েজ হবে না। (তাতারখানিয়া: ২/৬৬৭)
যদি সে রুকু-সিজদা করতে অপারগ হয় এবং মাটিতে বসে ইশারা করে নামাজ আদায় করতে সক্ষম হয়, তবে যেভাবেই সম্ভব মাটিতে বসে ইশারা করে নামাজ আদায় করবে। কারণ শরিয়ত এমন অপারগদের মাটিতে বসার ব্যাপারে পূর্ণ ছাড় দিয়েছে। যে আসনে সম্ভব হয়, সেভাবেই বসে নামাজ আদায় করবে। (দুররে মুখতার: ২/৫৬৬)
-এমন ব্যক্তির প্রয়োজন ছাড়া চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করা অনুচিত। যদি কোনোভাবেই মাটিতে বসে নামাজ আদায় করার সাধ্য ও সামর্থ্য না থাকে, তবে চেয়ারে বসে ইশারার মাধ্যমে নামাজ আদায় করা যাবে। কিন্তু যদি যেকোনোভাবে মাটিতে বসে রুকু-সিজদা করার সামর্থ্য থাকে, তবে চেয়ারে নামাজ আদায় করা জায়েজ হবে না।
-যে ক্ষেত্রে শরীয় ওজরের কারণে চেয়ারে বসে ইশারার মাধ্যমে নামাজ আদায় করার অনুমতি রয়েছে, সে ক্ষেত্রে সিজদার সময় ইশারার ওপরই ক্ষান্ত হওয়া উচিত।
উল্লিখিত দীর্ঘ আলোচনার সংক্ষিপ্ত নিম্নরূপ:-
১. যে ব্যক্তি দাঁড়াতে সক্ষম নয়, কিন্তু যেকোনোভাবে মাটিতে বসে রুকু-সিজদা করে নামাজ আদায় করতে পারে, তাকে মাটিতে বসেই রুকু-সিজদা করে নামাজ আদায় করতে হবে। চেয়ার ইত্যাদিতে বসে ইশারায় রুকু-সিজদা করে নামাজ আদায় করা জায়েজ হবে না।
২. আর কেউ যদি দাঁড়াতে পারে, কিন্তু কোমর বা হাঁটুতে প্রচ- ব্যথা হওয়ায় সিজদা করার শক্তি না রাখে অথবা সে মাটিতে বসতে পারে, কিন্তু রুকু-সিজদার শক্তি রাখে না, এরূপ লোক মাটিতে বসে নামাজ আদায় করবে। চেয়ার ইত্যাদির ব্যবহার তাদের জন্য উচিত নয়। হ্যাঁ, যদি কোনোভাবেই মাটিতে বসা দু:সাধ্য হয়ে পড়ে, তখন চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করা যেতে পারে। এ অবস্থায় চেয়ার ব্যবহার করলেও সাদামাটা চেয়ার ব্যবহার করবে। আসলে অসুস্থ ব্যক্তির অবস্থাভেদে চেয়ারে বসে নামাজ আদায়ের বিভিন্ন হুকুম হতে পারে। তাই এ বিষয়ে ঢালাও মন্তব্য কাম্য নয়।
অচেতন ব্যক্তি কখন নামাজ আদায় করবে: কোনো লোক পাগল বা বেহুঁশ হয়ে পড়লে তখন দেখতে হবে এ অবস্থা কতক্ষণ বিদ্যমান থাকে। যদি পাঁচ ওয়াক্ত বা তার কম সময় হয়, তাহলে ভালো হওয়ার পর তা কাজা করবে। যদি এর চেয়ে বেশি হয়, তবে ওই সময়কার নামাজ কাজা করতে হবে না। (প্রাগুক্ত)
যে ব্যক্তি দাঁড়িয়ে নামাজ শুরু করল, অত:পর দাঁড়াতে অক্ষম হয়ে গেল, তখন সে বসে নামাজ পরিপƒর্ণ করবে, যদি বসতেও অক্ষম হয়ে যায়, তবে শুয়ে হলেও তা পরিপূর্ণ করবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১০৫০)
কাজা নামাজের বিধান: আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘নামাজ মুমিনের জন্য নির্দিষ্ট সময়ে ফরজ।’
তাই কোনো ওজর ব্যতীত নামাজ সময় থেকে দেরি করা জায়েজ নেই। (সুরা নিসা, আয়াত: ১০৩, সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪৯৬)
-কোনো ওজর বা অপারগতার কারণে নামাজ সময়মতো আদায় করতে না পারলে উক্ত অপারগতা খতম হওয়ার পর ওই নামাজের কাজা আদায় করা ফরজ। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৬২)
ফরজের কাজা ফরজ আর ওয়াজিবের কাজা ওয়াজিব। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৬২, ১৮১৬)
-সুন্নত আর নফলের কাজা করবে না। তবে সুন্নত বা নফল নামাজ আরম্ভ করার পর ভেঙে গেলে তা কাজা করা আবশ্যক। (সুরা মুহাম্মদ, আয়াত: ৩৩, তিরমিজি, হাদিস: ৬৬৭)
-যদি ফজরের সুন্নত ফজরের ফরজসহ কাজা হয়ে যায়, তবে সূর্য হেলার আগে আগে ফরজের সঙ্গে সুন্নতও কাজা করবে। (আবু দাউদ, হাদিস: ৭৫)
-যদি কাজা নামাজ বেশি হয় তখন কাজা পড়ার সময় প্রতিটি নামাজকে পৃথকভাবে কাজা করতে হবে। যদি নির্ধারণ করা কষ্টসাধ্য হয়, তবে এভাবে নিয়ত করবে যে আগে ছুটে যাওয়া জোহরের নামাজ পড়ছি বা পরে ছুটে যাওয়া জোহর বা আসর পড়ছি। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১)
নামাজ কখন ভেঙে দিতে পারবে: নামাজ আদায়কারীর জন্য কোনো শরিয়ত সমর্থিত অপারগতা ছাড়া নামাজ ভেঙে দেওয়া জায়েজ নেই। (সুরা মুহাম্মদ, আয়াত: ৩৩)
-নিজের মা-বাবা ডাকলে নামাজ ভেঙে দেওয়া জায়েজ। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪/৪০৪)
নামাজ আদায়কারী কোনো অন্ধকে কূপ অথবা কোনো গর্তের দিকে যেতে দেখে কূপে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা মনে হলে নামাজ ভেঙে দিতে পারবে। (তিরমিজি, হাদিস: ৩৫৫)
-যদি কোনো অত্যাচারিত ব্যক্তি নামাজ আদায়কারীর প্রতি সাহায্যের আবেদন জানিয়ে চিৎকার করে আর -যদি নামাজ আদায়কারী মনে করে সে তাকে জুলুম থেকে বাঁচাতে সক্ষম, তখন নামাজ ভেঙে দেওয়া আবশ্যক। (তিরমিজি, হাদিস: ৩৩৫)
-নামাজ আদায়কারী ব্যক্তি যদি কোনো চোরকে এক দিরহাম ন্যূনতম সমপরিমাণ মাল চুরি করতে দেখে, সে মাল নিজের বা অন্যের হোক নামাজ ভেঙে দেওয়া জায়েজ। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪/৪১২)
মুসাফির ব্যক্তি যদি চোরের ভয়ে শঙ্কিত হয়, তবে নামাজ বিলম্ব করা জায়েজ। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৬৩)
জামাতের আংশিক নামাজ ছুটে গেলে করণীয়: নামাজের জামাতে যে ব্যক্তির শুরুতে এক বা তার অধিক রাকাত ছুটে যায়, তাকে ‘মাসবুক’ বলা হয়। মাসবুক ব্যক্তি ইমামকে যে অবস্থায় পাবে, ওই অবস্থায়ই ইমামের সঙ্গে নামাজে শরিক হয়ে যাবে এবং যথারীতি নামাজ আদায় করবে। যদি সে প্রথম রাকাতের রুকুতে শরিক হতে না পারে, তবে ইমামের সঙ্গে বাকি নামাজ আদায় করে শেষ বৈঠকে শুধু তাশাহহুদ পড়ে চুপ করে বসে থাকবে। এরপর ইমামের উভয় দিকে সালাম ফেরানোর পর সে তার ছুটে যাওয়া রাকাতগুলো আদায় করে নেবে। (বাদায়েউস সানায়ে: ১/৩১৪)
-মাসবুকের ছুটে যাওয়া নামাজ আদায়ের পদ্ধতি হলো, কিরাত পড়ার ক্ষেত্রে তার ছুটে যাওয়া রাকাতকে প্রথম ও শুরু রাকাত ধরা হবে অর্থাৎ ফাতিহা পড়ার পর সুরা মেলাবে, আর বৈঠক ও তাশাহহুদ পড়ার ক্ষেত্রে ইমামের সঙ্গে পঠিতগুলোকে প্রথম ধরে বাকিগুলোকে পরবর্তী রাকাত গণ্য করে নামাজ আদায় করবে(আল মাবসুত সারাখসি: ১/১৯০, আল বাহরুর রায়েক: ১/৩৭৯)
-ওই নিয়মানুসারে কোনো ব্যক্তির এক রাকাত ছুটে গেলে সে ওই রাকাতে কিরাত সুরা মিলিয়ে পড়ে শেষ বৈঠক করে সালাম ফেরাবে। চার রাকাত বিশিষ্ট নামাজের জামাতে দুই রাকাত ছুটে গেলে যথারীতি উভয় রাকাতে কিরাত সুরা মিলিয়ে পড়বে এবং এর প্রথম রাকাতে না বসে শেষ রাকাতে বসে তাশাহহুদ, দরুদ ও দোয়া পড়ে সালাম ফেরাবে। (খুলাসাতুল ফাতাওয়া: ১/১৬৫)
-তিন রাকাতবিশিষ্ট নামাজের জামাতে দুই রাকাত ছুটে গেলে ইমামের সালামের পর যথারীতি উভয় রাকাতেই কিরাত সুরা মিলিয়ে পড়বে এবং প্রথম রাকাতে বসে তাশাহহুদ পড়ে উঠে যাবে। কেননা এ রাকাত বৈঠকের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় রাকাত হিসেবে ধর্তব্য হবে। অত:পর শেষ রাকাতে বসে সালাম ফেরাবে। (রদ্দুল মুহতার: ১/৫৯৬)
-যদি চার রাকাত বিশিষ্ট নামাজের জামাতে তিন রাকাত ইমামের পেছনে না পায়, তাহলে সালাম ফেরানোর পর ছুটে যাওয়া রাকাতের মধ্যে প্রথম দুই রাকাতে ফাতিহার সঙ্গে সুরা মিলিয়ে পড়বে এবং শেষ রাকাতে সুরা না মিলিয়ে শুধু ফাতিহা পড়বে। আর প্রথম রাকাতে বসে তাশাহ্হুদ পড়ে উঠে যাবে। এরপর দ্বিতীয় রাকাতে না বসে শেষ রাকাত পড়ে বৈঠক করবে। (রদ্দুল মুহতার: ১/৫৯৬)

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877